বিবিএন নিউজ: প্রায় দেড়শ’ কিলোমিটার বেগে ভারতের ওড়িশা উপকূল অতিক্রম করেছে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস। স্থলভাগে উঠে আসার পর ঘূর্ণিঝড়টি দুর্বল হয়ে ক্রমে শক্তি হারিয়ে ফেলে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ভারতের ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড়ের বড় কোনো প্রভাব বাংলাদেশে পড়েনি। তবে জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় ৯ জেলার ২৭টি উপজেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমাদের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, ভরা পূর্ণিমার সময় ঘূর্ণিঝড়ের হানায় স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক ফুট বেশি উচ্চতায় জোয়ার আসে। সঙ্গে জলোচ্ছ্বাস। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে অন্তত ৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
এর মধ্যে বরগুনার বেতাগী উপজেলায় আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পথে মায়ের কোল থেকে পানিতে পড়ে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। অতি জোয়ারের সময় মাছ ধরতে গিয়ে বরগুনার বামনা উপজেলায় আরো একজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মো. হাবিবুর রহমান। ফেনীর সোনাগাজীতে জোয়ারের পানিতে ডুবে যাওয়ার ৮ ঘণ্টা পর হাদিউজ্জামান (৪৫) নামে এক জেলের লাশ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিস। মঙ্গলবার বিকালে ছোট ফেনী নদীতে চিংড়ির পোনা ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হন তিনি। বাগেরহাটে জোয়ারের পানিতে ভেসে যাওয়া ৪ বছর বয়সী এক শিশুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। বুধবার দুপুরে মোড়েলগঞ্জ উপজেলার খাউলিয়া ইউনিয়নের চালিতাবুনিয়া গ্রাম থেকে শিশু জিনিয়ার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়াও ঘূর্ণিঝড় ইয়াস’র তাণ্ডবে ভোলার লালমোহন উপজেলায় গাছ পড়ে আবু তাহের নামের এক রিকশাচালক নিহত হয়েছেন।
গতকাল দুপুর নাগাদ বাংলাদেশকে ইয়াস’র প্রভাব থেকে মুক্ত ঘোষণা করেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান। প্রতিমন্ত্রী সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সার্বিক ঘূর্ণিঝড় পরিস্থিতি বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে জানান, বুধবার সকালে ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ ভারতের ওড়িশা উপকূল অতিক্রম শুরু করে। বিকাল ৪টা নাগাদ এটি ওড়িশা অতিক্রম করলেও বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়ের তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। তবে অতি জোয়ার বা জলোচ্ছ্বাসে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলার ২৭টি উপজেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে- শ্যামনগর, আশাশুনি, কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা, শরণখোলা, মোংলা, মোড়েলগঞ্জ, মঠবাড়ীয়া, বরগুনা সদর, পাথরঘাটা, আমতলী, পটুয়াখালী সদর, গলাচিপা, রাঙ্গাবালী, দশমিনা, মির্জাগঞ্জ, কলাপাড়া, চরফ্যাশন, মনপুরা, তজুমদ্দিন, দৌলতখান, বোরহানউদ্দিন, ভোলা সদর, হাতিয়া, রামগতি ও কমলনগর। প্রতিমন্ত্রী বলেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস’র প্রভাবে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় উপকূলীয় ৯টি জেলার ২৭টি উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্তদের মানবিক সহায়তা দিতে ১৬ হাজার ৫০০ শুকনা ও অন্যান্য খাবারের প্যাকেট সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদের বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ জেলা প্রশাসন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড় ইয়াস’র প্রভাবে উপকূলীয় ১৪টি জেলার অবস্থাও তুলে ধরেন প্রতিমন্ত্রী। পটুয়াখালীতে জোয়ারের পানি বেড়েছে, তবে বিপদসীমার নিচে আছে। ঝড়ের খবরে ১৭২টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ১৪ হাজার লোক আশ্রয় নিয়েছিল। লোকজন জোয়ারের সময় আশ্রয়কেন্দ্রে আসে এবং ভাটার সময় নিজ নিজ বাড়িতে চলে যায়। সাতক্ষীরায় জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ থেকে ৬ ফুট বেশি উঠেছে। কোনো কোনো জায়গায় বেড়িবাঁধ উপচে জোয়ারের পানি প্রবেশ করছে। জেলায় এক হাজার ২৯২টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত ছিল। শ্যামনগর উপজেলার বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে ২৮০ জন লোক আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। বরগুনায় জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ২-৩ ফুট বেশি বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়িবাঁধের কয়েক জায়গায় কিছু অংশ ভেঙে যাওয়ায় জোয়ারের পানি প্রবেশ করেছে। আশ্রয়কেন্দ্রে ৫২০ জন লোক আশ্রয় নিয়েছিল, পরে তারা নিজ বাড়িতে ফিরে গেছেন। ঝালকাঠি জেলায় মোট ৪৯৯টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত ছিল। ৪৯৭ জন লোক আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। জোয়ারের পানির উচ্চতা বিপদসীমার উপরে রয়েছে। পিরোজপুরের মঠবাড়ীয়া উপজেলার মাঝের চর বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করায় ১০/১২টি মাছের ঘের এবং কয়েক একর সবজি বাগান পানির নিচে চলে গেছে। মাঝের চর আশ্রয়কেন্দ্রে ২৫০ জন লোক আশ্রয় নিয়েছে। উপজেলা থেকে শুকনা খাবার সরবরাহ করা হয়েছে। জোয়ারের পানি স্বাভাবিক অবস্থা থেকে ৩ ফুট উপরে উঠেছে। ২৫৬টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। বরিশালে এক হাজার ৭১টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত ছিল। কোনো লোক আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় গ্রহণ করেনি। জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে সামান্য বেশি রয়েছে। ভোলা জেলায় জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ২/৩ ফুট উপরে উঠেছিল। দুর্গম চরে প্রায় ২৫০টি কাঁচা ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং জোয়ারের পানিতে ৯০০ গরু/মহিষ ভেসে গেছে। ৬৯১টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ২ হাজার লোক আশ্রয় নিয়েছিল। বাগেরহাটে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পেয়ে মোরেলগঞ্জ, শরণখোলা ও মোংলা উপজেলার ২০/২১টি গ্রামে জোয়ারের পানি প্রবেশ করেছে। এতে ২ হাজার ৭০০ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চাঁদপুরে কিছু ছিন্নমূল মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি, কমলগঞ্জ উপজেলার নিচু এলাকায় সামান্য জোয়ারের পানি উঠেছে। কিছু রাস্তাঘাট, ব্রিজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে কোনো লোক আশ্রয় গ্রহণ করেনি। খুলনা জেলায় মোট এক হাজার ৪৮টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত ছিল। জোয়ারের পানির উচ্চতা স্বাভাবিক আছে। ফেনীতে ট্রলারে মাছ ধরতে গিয়ে ট্রলার ডুবে একজন মারা গেছে। ৪৫টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছিল, কিন্তু কোনো লোক আশ্রয় গ্রহণ করেনি। চট্টগ্রামে জোয়ারের পানি বাড়ছে। বিপদসীমার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার মোট ৮৩৯টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। কোনো লোক আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়নি। নোয়াখালীতে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস’র কারণে জেলায় মোট ৩৯০টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে মোট ৩০০ জন লোক আশ্রয় নিয়েছিল। জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৪ ফুট উপরে উঠেছিল। জোয়ারের পানিতে নিম্নাঞ্চলের বাড়ি ঘরে পানি উঠেছে। কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব মো. মোহসীন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, প্রাথমিকভাবে কিছু ক্ষয়ক্ষতির হিসাব প্রস্তুত করা হয়েছে। আরেকটা সভা করে স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিবেদন তৈরি করা হবে। মাঠের কাজ শেষ হলে অল্প সময়ের মধ্যে আমরা সেটা করবো।