বিবিএন নিউজ : বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার আশা দিন দিন ফিকে হয়ে যাচ্ছে। আরও বেশি জটিল হচ্ছে সংকট। বিশ্বের অন্যান্য শরণার্থী সংকটের মতো রোহিঙ্গা সংকট সমাধানেও কার্যকর উদ্যোগ নিতে এখন পর্যন্ত সফল হয়নি জাতিসংঘ। বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশগুলোসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এ সংকটের স্থায়ী সমাধানের বিষয়টি গুরুত্ব হারাচ্ছে। উল্টো মিয়ানমারের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক জোরদার করতেই আগ্রহী প্রভাবশালী দেশগুলো।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রত্যাবাসন ও অধিকারের বিষয়ে রোহিঙ্গা নেতৃত্ব সৃষ্টিতে জাতিসংঘকে বিশেষ ভূমিকা নিতে হবে।
পাশাপাশি ভারত, চীন ও জাপানের যৌথ কার্যকর ভূমিকা প্রয়োজন। তা না হলে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান সম্ভব নয়।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সমকালকে বলেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ সংকট দীর্ঘায়িত হলে সেটা শুধু বাংলাদেশের আর্থসামাজিক পরিবেশ নয়, বরং এ অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। এ কারণে এই সংকটের স্থায়ী সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসন ছাড়া এ সংকটের স্থায়ী সমাধানের আর কোনো পথ নেই।
এমন পরিস্থিতিতে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব শরণার্থী দিবস। এ উপলক্ষে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে, ২০১৯ সালের পর থেকে দুই বছরে বিশ্বে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ৪ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিশ্বে শরণার্থীর সংখ্যা ছিল সাত কোটি ৯৫ লাখ। ২০২০ সালের শেষে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে আট কোটি ২৪ লাখ। ২০১১ সালের পর থেকে বিশ্বে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। ২০১১ সালেও বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বিশ্বব্যাপী ছিল চার কোটির কম। গত ১০ বছরে সেই সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি হয়ে আট কোটি ছাড়িয়ে গেছে।
এবারের বিশ্ব শরণার্থী দিবস পালনে জাতিসংঘের মূল প্রতিপাদ্য ‘টুগেদার উই হিল, লার্ন অ্যান্ড শাইন’ বা ‘আমরা একসঙ্গে সুস্থ থাকব, শিখব ও আলেকিত হব।’
যেখানে ধাঁধায় আটকে আছে :পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনের আলোচনাতেই ঘুরপাক খাচ্ছে রোহিঙ্গা সংকট। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ফোরামে রোহিঙ্গাদের সম্মানজনক প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে নানামুখী আলোচনা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে কোনো উদ্যোগ নেই। রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান নিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ ও নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা হলেও কোনো সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত আসেনি। কভিড-১৯ মহামারি শুরুর পর রোহিঙ্গা সংকট আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আরও গুরুত্ব হারিয়েছে। রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তার পরিমাণ কমেছে, প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনাও স্তিমিত হয়েছে। চীনের আগ্রহে বাংলাদেশ-মিয়ানমার-চীন ত্রিপক্ষীয় যে উদ্যোগ, তাও একটি বৈঠকের পর থমকে গেছে। সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখলের পর রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জান্তা সরকারের পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যে ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার সুযোগ ছিল, তাও নেওয়া হয়নি। ফলে সার্বিকভাবে ২০২১ সালে এসে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে এখন শুধু বাংলাদেশই উচ্চকণ্ঠ, আর কেউ নয়।
ঘটনাপ্রবাহ পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র সীমিত পরিসরে কিছু ছোটখাটো পদক্ষেপ নিলেও মিয়ানমার চাপ অনুভব করে এমন কোনো পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং মিয়ানমারে প্রভাবশালী অর্থনৈতিক অংশীদারদের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি; বরং মিয়ানমারে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পর আরও বেড়েছে।
আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চীন, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরের পর মিয়ানমারের চতুর্থ বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ইউরোপীয় কমিশনের পরিসংখ্যান অনুসারে, ইইউ এবং মিয়ানমারের মধ্যে মোট বাণিজ্যের পরিমাণ ২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ইউরো। এই সহযোগিতা আরও বাড়ছে। ২০১৭ সালের পর বাণিজ্যের পরিমাণ আগের চেয়ে প্রায় ১২ শতাংশ বেড়েছে। অন্যদিকে মার্কিন আদমশুমারি ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র-মিয়ানমার বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৫৭৭ দশমিক ৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৮ সালে সেই বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়ায় ১১,১৬৬ দশমিক ৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে ২০২০ সালে মহামারিজনিত পরিস্থিতির কারণে বাণিজ্যের পরিমাণ কমে এক হাজার ২৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমে আসে।